কোনো মানুষের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে তার উপর গোয়েন্দাগিরি করা ইসলাম সমর্থিত কিনা?
বর্তমান দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার
অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সভ্য বিশ্বের প্রত্যেকটি রাষ্ট্র ও
সমাজ প্রত্যেক মানুষের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা তথা প্রাইভেসিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া
হয়। অথচ কিছুদিন আগেও বিষয়টিকে দুনিয়ার মানুষ তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখতো না। আমাদের উপমহাদেশ
বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশ অঞ্চলের অবস্থা তো ছিলো আরো ভয়াবহ। এখানে “ব্যাক্তিগত” বলতে কোনো শব্দই ছিলো না।
বাংলাদেশের সমাজ হলো চুরান্ত কর্তৃত্ব পরায়ন ব্রাহ্মাণ্যবাদী সমাজ। তাই এখানে মানুষের
পার্সোনাল স্পেইস বা ব্যাক্তিগত পরিমন্ডল বলতে কিছু ছিলো না। এখানে ব্যাক্তির প্রত্যেকটা
জিনিশ চরম ভাবে সমাজ ও সমাজের মানুষ নজরদারী করতো। এমনকি কঠোর ভাবে তার প্রত্যেকটা
কাজে হস্তক্ষেপ করতো। “ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা” বলতে কিছু যে থাকতে পারে তা সে সময়ে মানুষের ধারণার বাইরে ছিলো। মানুষ ছিলো সমাজের
মাতব্বরদের দ্বারা তৈরি করা মানব সৃষ্ট কৃত্তিম এক কাঠামোর দাস। মানুষের তৈরি উদ্ভট
ও নিপীড়নমূলক নিয়মকানুনই মানুষকে মেনে চলতে হতো।
এমনকি মানুষের পারিবারিক পরিমন্ডল বা ফ্যামেলি স্পেস বলতেও কিছু
ছিলো না। পরিবারের প্রত্যেকটা ব্যাপারে সমাজ ও সমাজের ক্ষমতাবান মাতব্বরেরা নাক গলাতো।
পরিবার এক কথায় সমাজের মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতো, পরিবারের মানুষেরা তা মেনে চলতে বাধ্য
ছিলো। না হয় সমাজচ্যুত করা হতো।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, বাংলাদেশ তো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ
অঞ্চল, তাহলে এখানে এমন জাহেলিয়াত থাকে কি করে? আসলে বাংলার মুসলমানরা আসলে কালিমা
পরে মুসলমান হলেও আসলে তারা সাংস্কৃতিক ভাবে ব্রাহ্মাণ্যবাদী। তাদের সমাজ এখনো ব্রাহ্মাণ্যবাদী
উদ্ভট নিপীড়নমূলক নিয়ম-নীতি মেনে চলে। তাই এখানে প্রকৃত অর্থে মানুষের মুক্তি নেই।
তবে এই অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে ও প্রকৃত ইসলামী জ্ঞানের
বিস্তারের সাথে সাথে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে কিছুটা। তবে সমাজের বৃহৎ অংশ এখনো ব্রাহ্মাণ্যবাদী
অন্ধকারে নিমজ্জিত।
আজকের আধুনিক বিশ্ব যেখানে এতোদিনে এসে ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা
রক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিলো, সেই স্বীকৃতি ইসলাম ১৫০০ বছর আগেই
দিয়ে দিয়েছে। আসুন দেখে নেই, ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম কি
বলে-
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রতিটি মানুষকে স্বাধীন করে দুনিয়ায়
প্রেরণ করেছেন। পরবর্তীতে তার জীবন যাতে সুন্দর করে পরিচালনা করতে পারে, তাই কিছু নীতিমালা
পাঠিয়েছেন। সেসব নীতিমালাই হলো দ্বীন। ইসলামের চেয়ে সুন্দর কোনো দ্বীন বা জীবন ব্যাবস্থা
না দুনিয়াতে কোনোদিন এসেছে, না ভবিষ্যতে কোনোদিন আসবে। কারণ আল্লাহ মনোনিত দ্বীন এটাই।
এটাই মানুষকে প্রকৃত স্বাধীনতা দিতে পারে।
ইসলামে প্রতিটি মানুষ স্বাধীন। তাদের একটা ব্যাক্তিগত পরিমন্ডল তথা পার্সোনাল স্পেস আছে, সেখানে হস্তক্ষেপের বা নাক গলানোর অধিকার কারো নেই। এমন কি ইসলামি রাষ্ট্রেরও না।
সুরা হুজরাতের ১২ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,
“হে মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান কোরো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”
এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ৩ টি বিষয় নিষিদ্ধ করেছেন। প্রথমটি হলো মানুষের ব্যাপারে মন্দ ধারণা করা।
মানুষের বাহ্যিক কর্মকান্ড দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়েই তার ব্যাপারে মন্দ ধারণা
পোষণ করাকে ইসলাম এখানে নিষিদ্ধ করেছে। দ্বিতীয়টি হলো, গোপনীয় বিষয় সন্ধান না করা,
অর্থাৎ অন্যের উপর গোয়েন্দাগিরি বা গুপ্তচরবৃত্তি না করা। এই কাজে বাঙ্গালীরা এতোটাই
পারদর্শী যে বিশ্বের নামকড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বাঙ্গালীর কাছে হার মানবে। মূলত হাতে
কোনো কাজ কর্ম না থাকার কারণে সারাদিন অলস বসে থেকে বিরক্ত হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ বাঙ্গালীই
অন্যের উপর গোয়েন্দাগিরি করে নিজেদের সময় অতিবাহিত করে। যা ইসলাম সুস্পষ্ট ভাবে হারাম
করেছে। অন্যদিকে তৃতীয় নিষিদ্ধ বিষয়টি হলো গীবত। দুনিয়ার সব বিষয় থেকে বাঙ্গালীকে
বাঁচানো গেলেও গীবত থেকে ব্রাহ্মাণ্যবাদী বাঙ্গালী মুসলমানকে বিরত রাখাটা কঠিন। এরা
আলোচনায় বসলেই এদের আলোচনার অন্যতম বিষয় হয় অন্যের সমালোচনা। মূলত জ্ঞান থেকে হাজারো
মাইল দূরে অবস্থান করার কারণে এরা আলোচনার তেমন কোনো বিষয় খুঁজে পায় না। অথচ গীবত করা
নিজের মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমান অপরাধ।
একটি হাদিসে রাসুল
(সাঃ) বলেন,
‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, ধারণা মিথ্যা কথার নামান্তর।’ (সহিহ বুখারি:৪০৬৬, মুসলিম:২৫৬৩)।
অর্থাৎ কারো ব্যাপারে কেউ যদি মন্দ ধারণা করে, তবে এর গুনাহ
মিথ্যার গুনাহের সমপর্যায়ের। কারণ যার ব্যাপারে মন্দ ধারণা করা হয়েছে, হতে পারে সেই
ব্যাক্তি সেই কাজ করেন নি।
অন্যের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে তার উপর
গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়ে একবার নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার খুতবার বলেছেন,
‘হে সেই সব লোকজন, যারা মুখে ইমান এনেছ, কিন্তু এখনো ইমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলিমদের ‘গোপনীয়’ বিষয় খুঁজে বেড়িও না। যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ-ত্রুটি তালাশ করে বেড়াবে, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির অন্বেষণে লেগে যাবেন। আর আল্লাহ যার ত্রুটি তালাশ করেন, তাকে তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।’ (সুনানে আবু দাউদ :৪৮৮০)।
উমাইয়া খিলাফাতের প্রতিষ্ঠাতা ও রাসুলুল্লাহ
(সাঃ) এর বিখ্যাত সাহাবী হযরত মুআবিয়া (রা.) বলেন,
‘আমি নিজে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘তুমি যদি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য পেছনে লাগো। তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে কিংবা অন্তত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে।’ (সুনানে আবু দাউদ:৪৮৮৮)।
অন্য এক হাদিসে নবীজী (সাঃ) বলেন,
‘যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্ব-গৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন।’ (সুনানে আবু দাউদ :৪৮৮০)।
এ ক্ষেত্রে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর একটি
অতীব শিক্ষাণীয় ঘটনা আছে-
“একবার রাতের বেলা তিনি এক ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে পেলেন। সে গান গাইতেছিল। তার সন্দেহ হলো। তিনি তার সাথি আবদুর রহমান ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, ঘরটি কার? বলা হলো, এটা রবিআ ইবন উমাইয়া ইবন খালফের ঘর। তারা এখন শরাব খাচ্ছে। আপনার কী অভিমত? অতঃপর আবদুর রহমান ইবন আওফ বললেন, আমার অভিমত হচ্ছে যে, আমরা আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা-ই করে ফেলছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের তা করতে নিষেধ করে বলেছেন, ‘তোমরা গোপন বিষয় অন্বেষণ কোরো না।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত :১২)। তখন ওমর ফিরে এলেন এবং তাকে ছেড়ে গেলেন।” [মুস্তাদরাকে হাকিম :৮২৪৯, মাকারিমুল আখলাক: আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাফর আল খারায়েতি:৩৯৮, ৪২০, মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক :১০/২২১)।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের উপর গোয়েন্দাগিরি করে তাদের
দোষ-ত্রুটি খুঁজে খুঁজে বের করা ও পাকড়াও করা শুধু ব্যাক্তি নয় ইসলামি রাষ্ট্রের জন্যও না জায়েজ।
একটি হাদিসেও এ কথা উল্লেখিত হয়েছে,
নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শাসকেরা যখন সন্দেহের বশে মানুষের দোষ অনুসন্ধান করতে শুরু করে, তখন তা তাদের চরিত্র নষ্ট করে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ :৪৮৮৯)।
একজন মুসলিমের পক্ষে কোনোদিনই এটা শোভনীয় নয়
যে সে নিজের কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে অকর্মার মতো বসে বসে খাবে আর অন্যের উপর
গোয়েন্দাগিরি করে একজনের ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা লঙ্ঘন করবে। এটা ভয়ানক
গুনাহের বিষয় ও হারাম। ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা একজন ব্যাক্তির আমানত। তাই এতে হাত
দেয়া একজন মুসলিমের পক্ষে উচিৎ নয়।
আর কখনো কোনো মুসলিমের কোনো দোষ-ত্রুটি যদি
চোখে পরেও যায়, তবে অপর মুসলিমের
পক্ষে উচিৎ সেটা গোপন করা। এতে আল্লাহও সেই ব্যাক্তি দোষ-ত্রুটি কেয়ামতের দিন গোপন
করবেন। আর যদি সে উক্ত ব্যাক্তির দোষ-ত্রুটি মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেয়, তবে আল্লাহও দুনিয়ায় তার দোষ-ত্রুটি মানুষের
সামনে প্রকাশ করে তাকে লাঞ্চিত করে ছাড়বেন। আর কেয়ামতেও তার সব গুনাহ মানুষের
সামনে প্রকাশ করে দেয়া হবে।