জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহঃ বাংলার বারকে খান
প্রারম্ভ
ইসলাম হলো এমন এক পরশ পাথর যার ছোঁয়া পেলে নিমিষেই বদলে
যায় যেকোন মানুষ। ঈমানের স্বাদ একবার যে ব্যাক্তি আস্বাদন করেছে তার কাছে তার এক ও
অদ্বিতীয় রবের হুকুমই সবার আগে। এই হুকুম পালন করতে গিয়ে কোনোদিন যদি নিজ পরিবারের,
এমন কি সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধেও যেতে হয়; কখনো
যদি নিজ আপনজনদের বিরুদ্ধে তরবারিও ধরতে হয়, তবুও মুমিন পিছপা হয় না। এর বহু নজির ইসলামের
১৫০০ বছরের ইতিহাসে রয়েছে। খোদ বদরের ময়দানে আমরা দেখেছি যে বাবা মুসলিম শিবিরে আর
সন্তান কাফিরদের শিবিরে। অথবা সন্তান হয়তো মুসলিমদের শিবিরে কিন্তু বাবা কাফিরদের শিবিরে।
পরষ্পর পরষ্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে শুধু মাত্র ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে। এমন অনেকের
নামই আমরা জানি যারা যুগে যুগে ইসলামকে রক্ষায় নিজ পরিবারের বিরুদ্ধেও তরবারি ধরেছে;
যেমন চেঙ্গিস খানের নাতি বারকে খান এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আমরা বাংলা অঞ্চলের মুসলিমরা
কি জানি যে আমাদের এই অঞ্চলেও এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি ইসলামকে রক্ষার জন্য নিজ
পিতার বিরুদ্ধে তরবারি ধরেছিলেন। পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন এই অঞ্চলের মুসলিমদের। তেমনি
একজন ব্যাক্তি হলেন বাংলা সালতানাতের সুলতান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ।
চলুন আজ তবে পরিচয় হওয়া যাক ইসলামের এই মহান সিপাহসালারের
সাথে।
পূর্বকথন
প্রবল প্রতাপশালী দিল্লি সালতানাত থেকে আলাদা হয়ে শামসউদ্দিন
ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা অঞ্চল নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পুরো বাংলা অঞ্চলে
বিস্তৃত তাঁর সাম্রাজ্যের নাম হয় “বাংলা সালতানাত”। আর তিনিই হন বাংলার প্রথম স্বাধীন
সুলতান তথা “শাহ-ই-বাঙ্গালা”। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর উত্তরসূরীদের পরবর্তী দুই প্রজন্ম
বেশ প্রতাপের সাথে সালতানাত শাসন করেছে। তাঁরাও তাঁদের পূর্বসূরীর মতোই ন্যায়পরায়ণ
শাসক ছিলেন। তাঁর বংশের সর্বশেষ শক্তিশালী শাসক ছিলেন গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ।মূলত তাঁর
মৃত্যুর পর থেকেই মূল সমস্যার শুরু হয়।
সমস্যার শুরু
সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ ইলিয়াস শাহী রাজবংশের অন্যতম
সুপরিচিত, প্রসিদ্ধ, জনপ্রিয় ও শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনি মূলত সামরিক অভিযানের চেয়ে
তৎকালীন বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও সালতানাতের শাসন সুসংহতকরণের
দিকেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। তবে তাঁর শাসনামলে তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ
রাজপদ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজে ব্যাপক পরিমাণে হিন্দুদের নিয়োগ দিয়েছিলেন।
মূলত সে সময়ের বাংলা অঞ্চলের হিন্দু সামন্ত রাজা ও জমিদাররা বাংলায় সেন বংশ পরবর্তী
সময়ের মুসলিম শাসনকে কোনোদিনই মেনে নিতে পারে নি। প্রকাশ্যে বিরোধীতা না করলেও তারা
গোপনে বাংলায় পুনরায় হিন্দু শাসন জারি হোক তা মনে প্রাণে চাইতো। যদিও মুসলিম শাসনামলে
তাদেরকে কোনোদিনই শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার কারণে কোনো বৈষম্যের স্বীকার হতে হয় নি।
যাই হোক, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সময়ে তারা ব্যাপক পরিমাণে
সালতানাতের প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ পেতে থাকে। এ সকল হিন্দু সামন্ত রাজা ও জমিদাররা নিজেদের
মধ্যে গোপন কঠোর যোগাযোগ রক্ষা করতো। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী ছিলো
রাজা গণেশ। যে মূলত ছিলো তাদের নেতা।
কে এই গণেশ?
গণেশনারায়ণের জন্ম হয় একটাকিয়ার কাশ্যপ গোত্রীয় বরেন্দ্র
ব্রাহ্মণ ভাদুড়ি বংশে। মূলত এই ভাদুরিদের একটি শাখাই রায় ও আরেকটি শাখা খাঁ উপাধি পেয়েছিলো
সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময়ে। বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ রিয়াজ-উস-সালাতিন
মতে, রাজা গণেশ মূলত বর্তমান বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপূর উপজেলার “ভাতুরিয়ার
জমিদার” ছিলো।
মূলত গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সময়ে সে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত
থাকার কারণে ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করে। ১৪১১ সালে গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের
মৃত্যুর পর সে তাঁর স্বরূপে আবির্ভূত হয়। ঐতিহাসিকদের একটি অংশ ধারণা করেন যে, গিয়াসউদ্দীন
আজম শাহের মৃত্যুর পেছনে রাজা গণেশের হাত রয়েছে।
গণেশের ক্ষমতা করায়ত্তকরণ
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফউদ্দিন
হামজা শাহ “সুলতান-উস-সালাতিন” উপাধি
গ্রহণ করে সিংহাসনে বসেন। রাজা গণেশের চক্রান্তে তখন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ
দেখা দেয়। তিনি তখন পরিস্থিতি সামলানোর আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু পরবর্তীতে
তিন বছরের মাথায় রাজা গণেশের ইশারায় তিনি তাঁর দাস শিহাবউদ্দীন কর্তৃক নিহত হন।
সাইফউদ্দিন হামজা শাহ এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ
শাহ ক্ষমতায় বসে তবে এক বছরের মধ্যে রাজা গণেশের চক্রান্তে তিনিও গুপ্তচর কর্তৃক নিহত
হন। মূলত গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের মৃত্যুর পর সাইফউদ্দীন হামজা শাহ ও শিহাবউদ্দীন ছিলো
গণেশের হাতের পুতুল।
এরপর গণেশ ইলিয়াস শাহী রাজবংশের দাস শিহাবউদ্দীনকে শিহাবউদ্দীন
বায়েজিদ শাহ উপাধী দিয়ে ক্ষমতায় বসায় ও পেছন থেকে নিজের শাসনকাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
এক বছর শাসন করার পর শিহাবউদ্দীন বায়েজিদ শাহকেও গুপ্তচর দিয়ে খুন করিয়ে তাঁর পুত্র
প্রথম আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ’কে ক্ষমতায় বসায়, যে ছিলো গণেশের কেনা গোলামের মতো। এরপর
এক বছর তাঁকে দিয়ে শাসন করানোর পর ১৪১৪ সালে তাঁকেও গুপ্তচর দিয়ে খুন করায় এই গণেশ।
এরপর সে নিজে “মহারাজ গণেশ নারায়ণ রায় ভাদুড়ি” উপাধি নিয়ে ক্ষমতায় আরোহন করে।
গণেশ চাইলে অনেক আগেই গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের মৃত্যুর পর
নিজে ক্ষমতায় আরোহন করতে পারতো, কিন্তু যেহেতু তৎকালীন সময়ে বাংলা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর
একটি বড় অংশ ছিলো মুসলিম, তাছাড়া সেনাবাহিনী, রাজপরিষদ ও প্রশাসনের একটি অংশে মুসলিমরা
ছিলো, তাই সে শুরুতেই নিজে ক্ষমতা গ্রহণের ঝুঁকি নিতে চায় নি। একেরপর এক পুতুল শাসক
বসিয়ে নিজেই পর্দার আড়াল থেকে শাসন চালিয়ে গেছে ও নিজ ক্ষমতা সুসংহত করণে কাজ করে গেছে।
পরে সুযোগ বুঝে নিজেই সালতানাতের সিংহাসনে আরোহন করে বসেছে।
গণেশের শাসনামল
১৪১৪ সালে ক্ষমতায় আরোহন করেই সে সালতানাতের বিলুপ্তি ঘোষণা
করে ও বাংলাকে “হিন্দু সাম্রাজ্য” ঘোষণা করে। নিজে মহারাজা উপাধি নিয়ে শাসন কাজ চালিয়ে
যায়। প্রয়াত সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ এর স্ত্রীকে সে জোরপূর্ব বিয়ে করে ও দিনের
পর দিন তাঁকে ধর্ষণ করে। অনেক মুসলিম নারীদেরকেই সে তার রক্ষিতায় পরিণত করেছিলো।
তার শাসনামলে সবচেয়ে নির্যাতনের স্বীকার ছিলো বাংলার মুসলিমরা।
এই সময়ে বাংলা অঞ্চলের সব মসজিদকে জোরপূর্বক কাছাড়িঘর ও ঘোড়া রাখার যায়গায় পরিণত করা
হয়। এই সময় প্রকাশ্যে আজান দেয়া ও নামাজ পড়া নিষিদ্ধ ছিলো। তাছাড়া মুসলিমরা এ সময় কোরবানীও করতে
পারতো না। তার শাসনামলে মুসলিমদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়।
গণেশের অত্যাচার থেকে রক্ষা পায় নি বাংলায় ধর্ম প্রচার
করতে আসা সুফি সাধকরাও। তাঁদেরকেও পাইকারি হারে হত্যা করা হয়।
তৎকালীন সময়ের একটি হত্যাকান্ডের ঘটনায় গণেশের সময়ে মুসলিম
সুফি ও ধর্মপ্রচারকদের উপর নির্যাতনের বিষয়টি ফুটে ওঠে। সে সময়কার বিখ্যাত সুফি সাধক
শেখ মুঈনউদ্দীন আব্বাস এর পুত্র শেখ বদর-উল-ইসলামকে রাজা গণেশকে কুর্নিশ করে অভিবাদন
না করায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিনই তার রাজ্যের সব শিক্ষিত মুসলিমদের নৌকা দিয়ে
নদীর মাঝখানে নিয়ে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
মুসলিমদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেলে
শেখ নুর কুতুব-উল-আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শাহ শর্কি’কে একটি পত্র পাঠিয়ে গণেশের
অত্যাচারের ব্যাপারে অবহিত ছিলেন। এই খবর পাওয়া
মাত্রই সুলতান ইব্রাহিম শর্কি তাঁর আধ্যাত্মিক ওস্তাদ দরবেশ শাহাব উদ্দীন জৌনপুরী’র
কাছে পরামর্শ চান। শাহাব উদ্দীন জৌনপুরী তাঁকে তাঁর মুসলিম ভাইদের রক্ষার জন্য বাংলা
আক্রমণ করতে উপদেশ দেন।
ওস্তাদের অনুমোদন পাওয়া মাত্রই ইব্রাহিম শর্কি তাঁর বিশাল
বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হয়ে যান গণেশের বিরুদ্ধে। এতো বিপুল রণসজ্জিত বিশাল শক্তিশালী বাহিনীর
মোকাবিলা করার ক্ষমতা গণেশের ছিলো না। ইব্রাহিম শর্কির বাহিনী যখন ফিরোজপুরে এসে শিবির
স্থাপন করে, তখন ধুর্ত গণেশ অবস্থা বেগতিক দেখে শেখ নুর কুতুব-উল-আলমের পায়ে ধরে ক্ষমা
চেয়েছিলো।
তখন শেখ নুর কুতুব-উল-আলম বলেন, গণেশ যদি ইসলাম গ্রহণ করে,
তাহলেই কেবল তিনি ইব্রাহিম শর্কিকে গণেশের রাজ্য আক্রমণ না করতে অনুরোধ করবেন। ধুর্ত
গণেশ নিজের ক্ষমতা রক্ষার জন্য নিজধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে দিক্ষিত হতে চেয়েছিলো, কিন্তু
তার প্রথম স্ত্রী তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে দেয় নি।
পরে ধুর্ত গণেশ নিজের পরিবর্ততে নিজের ছোট ছেলে যদু নারায়ণ’কে
ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করার প্রস্তাব দেন। গণেশের অনুরোধে কুতুব-উল-আলম যদুকে ইসলামে
দিক্ষিত করেন এবং তাঁর নাম দেন, জালালুদ্দীন। এই সময় গণেশ নিজে সিংহাসন থেকে নেমে তার
পুত্র জালাল উদ্দীনকে সিংহাসনে বসায়। যদু সুলতান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ নাম নিয়ে
সিংহাসনে বসে। তাঁর নামে চারদিকে খুৎবা পাঠ করানো শুরু হয়।
এই সময় শেখ নুর কুতুব-উল-আলম সুলতান ইব্রাহিম শর্কির শিবিরে
গিয়ে তাকে গৌড় আক্রমণ করতে নিষেধ করেন। কারণ যদু যেহেতু এখন ইসলাম গ্রহণ করে সিংহাসনে
বসেছে, তাই এখন সে একজন মুসলিম সুলতান। একজন মুসলিম শাসক আরেকজন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করতে পারে না, কারণ তারা উভয়েই দ্বীনি ভাই। তাই ইব্রাহিম শর্কি তাঁর বিশাল বাহিনী
নিয়ে জৌনপুর ফিরে যান।
জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ এর শাসনামল
জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ তাঁর পিতার মতো কুসংস্কারাচ্ছন্ন,
কট্টর গোঁড়া ও উগ্র মুসলিম বিদ্বেষি ছিলো না। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তিনি ছিলেন একজন
খোলা মনের চিন্তাশীল ব্যাক্তি। ইসলাম গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহনের পর তিনি ধীরে ধীরে
ইসলাম সম্পর্কে জানতে শুরু করেন। এ সময় তিনি আলেম-ওলামা ও সুফিদের সংস্পর্শে গিয়ে ইসলাম
বিষয়ে বিস্তৃত ধারণা লাভ করেন। ইসলামের সৌন্দর্য ও এর প্রশান্তিময় পরিশুদ্ধ জীবন ব্যাবস্থা
তাঁকে এক প্রশান্তির ছোঁয়া দেয়, যা থেকে তিনি এতোদিন বঞ্চিত ছিলো। এ সময় তিনি প্রথম
এক বছর বেশ শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামী আইন দিয়ে তাঁর রাজ্য শাসন করে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু তাঁর ক্ষমতায় আরোহনের এক বছরের পর জৌনপুরে সুলতান
ইব্রাহিম শর্কি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতালোভী ধুর্ত গণেশ বিশাল এক সুযোগ
হাতে পায়। সে তার পুত্র জালালুদ্দিনকে সিংহাসনচ্যুত ও বন্দি করে। এ সময় জালালুদ্দিনকে
গণেশ জোরপূর্ব ধর্মান্তরিত করায়। সুবর্ণধেনু যজ্ঞ এর মাধ্যমে জালালুদ্দিনকে ধর্মান্তরিত
করা হয়। এই যজ্ঞের নিয়মানুযায়ী স্বর্ণ দিয়ে একটি বিশাল গাভী নির্মাণ করা হয় এবং জালালুদ্দিনকে
এর মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে পশ্চাৎদেশ দিয়ে বের করা হয়।
যজ্ঞের পর এই স্বর্ণ নির্মিত গাভীর স্বর্ণ যজ্ঞে অংশগ্রহণকারী
পন্ডিতদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এ সময় পন্ডিতরা স্বর্ণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি লেগে
যায়। এসব দেখে জালালুদ্দিন বুঝে যায় যে, এই ধর্ম সত্য হতে পারে না। তখন সে এই কথায়
সকলের সামনে বলে। যার ফলে গণেশ তাঁকে পুনরায় বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে।
এরপর গণেশ আবার সিংহাসনে বসে তাঁর অত্যাচারী শাসন চালিয়ে
যায়। ১৪১৬-১৪১৮ সাল পর্যন্ত চলে তাঁর অত্যাচারী
শাসন। এই সময় অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে
জালালুদ্দিন জেলে বসেই ইসলাম ও মুসলিমদের রক্ষায় নিজের পিতাকে হত্যার ছঁক আঁকেন। এরপর
পরিকল্পনা অনুযায়ী জালালুদ্দিনের পাঠানো গুপ্তচর ১৪১৮ সালে গণেশকে হত্যা করে। এরপর
গণেশের বড় ছেলে মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে। তখন জালালুদ্দিন তাঁর ভাই মহেন্দ্রকে উৎখাত
করে নিজে ক্ষমতায় বসেন। তিনি পুনরায় কালেমা পড়ে মুসলিম হন এবং বাংলাও পুনরায় মুসলিম
সালতানাতে পরিণত হয়।
জালালুদ্দিনের প্রকৃত শাসনামল
১৪১৮ থেকেই সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহের প্রকৃত শাসনকাল
শুরু হয়। প্রায় দু’দশকের শান্তিপূর্ণ শাসনামলে প্রজারা বেশ শান্তিতেই ছিলো। তাঁর সাম্রাজ্যের
প্রতিটি স্থানে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এই সময়ে তিনি পূর্ববঙ্গ (মুয়াজ্জমাবাদ)
ও চট্টগ্রাম সহ পুরো বাংলার উপর কতৃত্ব স্থাপন করেন। তিনি ফাতেহাবাদ (ফরিদপুর) দখল
করে দক্ষিণ বঙ্গে নিজ রাজ্য সম্প্রদারিত করেন।
জালালুদ্দিনের শাসনামলেই আরাকানের ম্রাউক-উ সাম্রাজ্য বার্মার
সম্রাটের আক্রমণের স্বীকার হয়। তখন ম্রাউক-উ সাম্রাজ্যের রাজা নরমেখলা সিংহাসনচ্যুত
হন ও তাঁর রাজ্য বার্মার উপনিবেশে পরিণত হয়। তখন নরমেখলা সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ
শাহ এর আশ্রয়ে আসেন ও তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। জালালুদ্দিন নরমেখলাকে বিশাল সেনাবাহিনী
দিয়ে সহায়তা করে, যা দিয়ে নরমেখলা তাঁর হৃতরাজ্য পুনরূদ্ধার করে। এর প্রতিদান স্বরূপ
ম্রাউক-উ (আরাকান) বাংলা সালতানাতের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। তখন থেকেই ম্রাউক-উ সাম্রাজ্যের
রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বি হওয়া স্বত্ত্বেও ইসলামি নাম ধারণ করতেন ও ইসলামি সংস্কৃতি
চর্চা করতেন। সে সময়ে বাংলা ও আরাকানের মাঝে ব্যাপক পরিমাণে বানিজ্যিক সম্পর্কের ফলে
বাঙালি মুসলিমরা আরাকানে যাতায়াত শুরু করে। তাদের থেকে আরাকানিরা উন্নত ইসলামি সভ্যতার
সাথে পরিচিত হয়। এর ফলে ব্যাপক পরিমাণে আরাকানি ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়, যাদের বংশধররাই
হলো বর্তমানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি। এ সময় ম্রাউক-উ সাম্রাজ্যের উচ্চরাজপদ ও সেনাবাহিনীতেও
ব্যাপক পরিমাণে মুসলিমরা কাজ করতো।
ইসলামের প্রতি ভালোবাসা
জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ ব্যাক্তিগত জীবনে হানাফি মাযহাবের
অনুসারী ছিলেন ও উলামা-মাশায়েখদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন। তিনি গণেশের সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত
বিভিন্ন মসজিদ পুনরায় নির্মান করেন। তাঁর আমলে ব্যাপক পরিমাণ মসজিদ, মাদ্রাসা, পুকুর
ও সরাইখানা নির্মান করা হয়। এ সময় অমুসলিমরাও ইসলামি আইনের অধীনে শান্তিতে বসবাস করছিলো
ও নিজেদের পূর্ণ অধিকার পাচ্ছিলো।
ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে জনগণকে রক্ষা
আর্যদের ভারতবর্ষে
আগমণের পর থেকেই ভারতের জনগণকে চারবর্ণে বিভক্ত করা হয়; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য,
শূদ্র। ব্রাহ্মণরা সমাজে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হতো। তারাই ছিলো রাষ্ট্রের প্রকৃত
শাসক। সমাজ তাদের কথা মতোই চলতো। তাদের কাজকর্ম শুধু ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না।
বরং ধর্মের নামে বৈশ্য ও শূদ্রদের উপর চরম অমানবিক নির্যাতন করা হতো। ক্ষত্রীয়রা রাষ্ট্র
শাসন করতো, আইন-শৃঙ্খলরা রক্ষা ও যুদ্ধ করাটাই ছিলো তাদের কাজ। আসলে ক্ষত্রীয়রা ছিলো
ব্রাহ্মণদের লাঠিয়াল বাহিনী। ব্রাহ্মণরা সমাজে নির্যাতন চালাতো, আর ক্ষত্রীয়দের কাজ
ছিলো তাদেরকে সাধারণ জনগণের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। মুসলিম শাসনামলে ব্রাহ্মণরা রাষ্ট্রীয়
পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও সাধারণ মানুষের উপর ও সমাজের উপর তাদের ছিলো প্রভূত নিয়ন্ত্রণ।
রাজা গণেশের ক্ষমতারোহনের পর সমাজের ব্রাহ্মণদেরকে আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া
হয়। রাজা গণেষের স্বল্পকালের শাসনামলেই তারা নিজেদের অত্যাচারের মাত্রাপূর্বের চেয়ে
বাড়িয়ে দেয়।
জালালুদ্দিন মোহাম্মদ
শাহ নিজেও ছিলেন একজন বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ। তাই তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপটার
সাথে পরিচিত ছিলেন। তাই ক্ষমতায় এসেই তিনি ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা খর্ব করেন। যেহেতু তিনি
মুসলিম ছিলেন, আর ইসলাম সমতায় বিশ্বাসী। তাই বাংলা সালতানাত থেকে মানুষের উপর মানুষের
প্রভুত্বকে খর্ব করা হয়।
জালালুদ্দিনের পররাষ্ট্রনীতি
সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ তৎকালীন বিশ্বের বিভিন্ন
সাম্রাজ্যের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তুলেন। তৎকালীন মিশরের মামলুক সালতানাত
এর শাসক সুলতান আল-আশরাফ বার্সব, চীন সাম্রাজ্য এর সম্রাট ইয়াং লো, তৈমুরীয় সাম্রাজ্য
এর শাসক আমির তৈমুর লং এর পুত্র আমির শাহরুখ মির্জা, তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা – এঁদের
সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন।
ইসলামের প্রতি তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন আব্বাসী
খলিফা তাকে “বৈধ সুলতান” হিসেবে অনুমোদন হিসেবে খেলাত ও খেতাব দান করেন। জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ তাঁর মুদ্রায় ১৪৩১ সাল
থেকে “খলিফাতুল্লাহ” উপাধী ব্যাবহার শুরু করেন। তাঁর মুদ্রায় কালিমা শাহাদাৎ উৎকীর্ণ
থাকতো।
ইন্তেকাল
১৪৩৩ সাল, হিজরি মতে ৮৩৭ হিজরির রবি-উস-সানি’তে ইসলামের
এই মহান বীর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি যদি উম্মাহের দুঃসময়ে তাঁর নিজ পিতা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে
তরবারি ধরে ঢালের মতো উম্মাহকে রক্ষা না করতেন, তাহলে হয়তো বা আজ বাংলাও বাগদাদ বা
স্পেনের মতো ধ্বংস স্তুপে পরিণত হতো। আল্লাহ
উম্মাহর এই মহান বীরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমিন।
তথ্যসূত্রঃ
১। বাঙ্গালার ইতিহাস – রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
২। রিয়াজ-উস-সালাতিন – গোলাম হোসেন
৩। তাবকাৎ-ই-আকবরী
৪। তারিখ-ই-ফেরেশতা
৫। Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1875
৬। মুন্তাখাব-উত-তাওয়ারিখ
৭। Social
History of Bengal - DC Sanyal
৮। Hindu-Muslim relations in Bengal: medieval period -
Jagadish Narayan Sarkar,
৯। History of the Muslims of Bengal
১০। The Delhi Sultanate – Ramesh Chandra Majumder
১১। The Rise of Islam and
the Bengal Frontier, 1204-1760 - Richard Maxwell Eaton
১২। বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব ও বিকাশ এবং একটি
নতুন ধারার গোড়াপত্তন - মোহাম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক
১৩। History of Medieval India (Muslim Rule in India) - V.D. Mahajan
১৪। বাঙ্গালীর ইতিহাস – নিহাররঞ্জন
রায়
১৫। বাংলার ইতিহাস - রমেশচন্দ্র
মজুমদার